আবুল হাসান
তীব্র ৩০ : আবুল হাসানের বাছাই কবিতা
ষাটের দশকের অন্যতম জনপ্রিয়, মেধাবী কবি-প্রতিভা আবুল হাসান। মাত্র ২৮ বছরের জীবনকাল। এর মধ্যে আমরা তার কাছ থেকে পেয়েছি তিনটি কাব্যগ্রন্থ ও অগ্রন্থিত বেশ কিছু কবিতা। এছাড়াও রয়েছে গল্প ও কাব্যনাটক। বহুলপঠিত এই কবির রচনা থেকে ৩০টি কবিতা আমরা উপস্থাপন করছি পরস্পরের পাঠকদের জন্য। কবিতাগুলির বিভিন্ন পাঠ-পাঠান্তর আছে, মুদ্রিত পাতায় আছে বিচিত্র মুদ্রণপ্রমাদ। সেসব মিলিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য পাঠ তৈরির প্রয়াস এখানে লক্ষণীয়।
.
পরস্পর-এ আবুল হাসানের কবিতা প্রকাশের অনুমতি দেয়ার জন্য আমরা কবির পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ। বিশেষভাবে আবুল হাসানের ভগ্নিপতি কবি হাফিজুর রহমানের প্রতি আমাদের অনিঃশেষ ভালোবাসা।
রাজা যায় রাজা আসে
[প্রকাশ ১৯৭২]
আবুল হাসান
সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র,
মায়াবী করুণ
এটা সেই পাথরের নাম নাকি? এটা তাই?
এটা কি পাথর নাকি কোনো নদী? উপগ্রহ? কোনো রাজা?
পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্নাভেজা চোখ?
মহাকাশে ছড়ানো ছয়টি তারা? তীব্র তীক্ষ্ণ তমোহর
কী অর্থ বহন করে এই সব মিলিত অক্ষর?
আমি বহুদিন একা একা প্রশ্ন করে দেখেছি নিজেকে,
যারা খুব হৃদয়ের কাছাকাছি থাকে, যারা এঘরে ওঘরে যায়
সময়ের সাহসী সন্তান যারা সভ্যতার সুন্দর প্রহরী
তারা কেউ কেউ বলেছে আমাকে—
এটা তোর জন্মদাতা জনকের জীবনের রুগ্ণ রূপান্তর,
একটি নামের মধ্যে নিজেরি বিস্তার ধরে রাখা,
তুই যার অনিচ্ছুক দাস!
হয়তো যুদ্ধের নাম, জ্যোৎস্নায় দুরন্ত চাঁদে ছুঁয়ে যাওয়া,
নীল দীর্ঘশ্বাস কোনো মানুষের!
সত্যিই কি মানুষের?
তবে কি সে মানুষের সাথে সম্পর্কিত ছিল, কোনোদিন
ভালোবেসেছিল সেও যুবতীর বামহাতে পাঁচটি আঙুল?
ভালোবেসেছিল ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আলোর ইশকুল?
পাখি হয়ে যায় প্রাণ
অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!
জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!
দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনোদিন।
ফাতিমা ফুফুর প্রভাতকালীন কোরানের
মর্মায়িত গানের স্মরণে তাই কেন যেন আমি
চলে যাই আজও সেই বর্নির বাওড়ের বৈকালিক ভ্রমণের পথে,
যেখানে নদীর ভরা কান্না শোনা যেত মাঝে মাঝে
জনপদবালাদের স্ফুরিত সিনানের অন্তর্লীন শব্দে মেদুর!
মনে পড়ে সরজু দিদির কপালের লক্ষ্মী চাঁদ তারা
নরম যুঁইয়ের গন্ধ মেলার মতো চোখের মাথুর ভাষা আর
হরিকীর্তনের নদীভূত বোল!
বড় ভাই আসতেন মাঝরাতে মহকুমা শহরের যাত্রাগান শুনে,
সাইকেল বেজে উঠত ফেলে আসা শব্দে যখন,
নিদ্রার নেশায় উবু হয়ে শুনতাম, যেন শব্দে কান পেতে রেখে :
কেউ বলে যাচ্ছে যেন,
বাবলু তোমার নীল চোখের ভিতর এক সামুদ্রিক ঝড় কেন?
পিঠে অই সারসের মতো কী বেঁধে রেখেছ?
আসতেন পাখি শিকারের সূক্ষ্ম চোখ নিয়ে দুলাভাই!
ছোটবোন ঘরে বসে কেন যেন তখন কেমন
পানের পাতার মতো নমনীয় হতো ক্রমে ক্রমে!
আর অন্ধ লোকটাও সন্ধ্যায়, পাখিহীন দৃশ্য চোখে ভরে!
দিঘিতে ভাসত ঘনমেঘ, জল নিতে এসে
মেঘ হয়ে যেত লীলা বৌদি সেই গোধূলিবেলায়,
পাতা ঝরবার মতো শব্দ হতো জলে, ভাবতুম
এমন দিনে কি ওরে বলা যায়—?
স্মরণপ্রদেশ থেকে এক একটি নিবাস উঠে গেছে
সরজু দিদিরা ঐ বাংলায়, বড়ভাই নিরুদ্দিষ্ট,
সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি সাথে করে নিয়ে গেছে গাঁয়ের হালট!
একে একে নদীর ধারার মতো তারা বহুদূরে গত!
বদলপ্রয়াসী এই জীবনের জোয়ারে কেবল অন্তঃশীল একটি দ্বীপের মতো
সবার গোচরহীন আছি আজও সুদূরসন্ধানী!
দূরে বসে প্রবাহের অন্তর্গত আমি, তাই নিজেরই অচেনা নিজে
কেবল দিব্যতাদুষ্ট শোনিতের ভারা ভারা স্বপ্ন বোঝাই মাঠে দেখি,
সেখানেও বসে আছে বৃক্ষের মতন একা একজন লোক,
যাকে ঘিরে বিশজন দেবদূত গাইছে কেবলি
শতজীবনের শত কুহেলি ও কুয়াশার গান!
পাখি হয়ে যায় এ প্রাণ ঐ কুহেলি মাঠের প্রান্তরে হে দেবদূত!
উচ্চারণগুলি শোকের
লক্ষ্মী বউটিকে
আমি আজ আর কোথাও দেখি না,
হাঁটি হাঁটি শিশুটিকে
কোথাও দেখি না,
কতগুলি রাজহাঁস দেখি
নরম শরীর ভরা রাজহাঁস দেখি,
কতগুলি মুখস্থ মানুষ দেখি, বউটিকে কোথাও দেখি না
শিশুটিকে কোথাও দেখি না!
তবে কি বউটি রাজহাঁস?
তবে কি শিশুটি আজ
সবুজ মাঠের সূর্য, সবুজ আকাশ?
অনেক রক্ত যুদ্ধ গেল,
অনেক রক্ত গেল,
শিমুল তুলোর মতো
সোনারুপো ছড়াল বাতাস।
ছোট ভাইটিকে আমি
কোথাও দেখি না,
নরম নোলক পরা বোনটিকে
আজ আর কোথাও দেখি না!
কেবল পতাকা দেখি,
কেবল উৎসব দেখি,
স্বাধীনতা দেখি,
তবে কি আমার ভাই আজ
ঐ স্বাধীন পাতাকা?
তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদিতে উৎসব?
একলা বাতাস
নোখের ভিতর নষ্ট ময়লা,
চোখের ভিতর প্রেম,
চুলের কাছে ফেরার বাতাস
দেখেই শুধালেম,
এখন তুমি কোথায় যাবে?
কোন আঘাটার জল ঘোলাবে?
কোন আগুনের স্পর্শ নেবে
রক্তে কি প্রব্লেম?
হঠাৎ তাহার ছায়ায় আমি যেদিকে তাকালেম
তাহার শরীর মড়িয়ে দিয়ে
দিগন্তে দুই চক্ষু নিয়ে
আমার দিকে তাকিয়ে আমি আমাকে শুধালেম
এখন তুমি কোথায় যাবে?
কোন আঘাটার জল ঘোলাবে?
কোন আগুনের স্পর্শ নেবে
রক্তে কি প্রব্লেম?
বয়ঃসন্ধি
চিকন কঞ্চির মতো ছিপছিপে রোদের ভিতরে আসি
কে আমাকে নুইয়ে দেয় মা? আমার ভীষণ ভয় লাগে!
পানাপুকুরের পাড়ে জলের আয়না আছে, মুখ ধুই
আমি কাকে নুইয়ে দিই মা? আমার ভীষণ ভয় লাগে!
নাসারন্ধ্রে নিমের ফুলের ঘ্রাণ, খয়েরি দুপুরে আমি
আলোর আঁধারে কেন ভেসে যাই মা? আমার ভীষণ ভয় লাগে!
আমার সুন্দর হতে ভালোই লাগে না; আমি ভয় পাই!
আমার শরীরে এই অসহবিসহ আলো, বিচ্ছুরণ তেলেসমাতির খেল
আমার শরীরে এই সোনালি ত্বকের ছটা বুক জোড়া উঁচু শিহরন!
কোথায় লুকাব মা? ভয় লাগে, আমার ভীষণ ভয় লাগে!
প্রতীক্ষার শোকগাথা
তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ পড়ে আছে দ্যাখো প্রশান্ত টেবিলে
আর আমার হাতঘড়ি
নীল ডায়ালের তারা জ্বলছে মৃদু আমারই কব্জিতে!
ট্যুরিস্টের মতো লাগছে দেখতে আমাকে
সাংবাদিকের মতো ভীষণ উৎসাহী
এ মুহূর্তে সিগ্রেটের ছাই থেকে
শিশিরের মতো নম্র অপেক্ষার কষ্টগুলি ঝেড়ে ফেলেছি কালো অ্যাসট্রেতে!
রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবে না আজ স্বাতী?
তোমার কথার মতো নরম সবুজ
কেকগুলি পড়ে আছে একটি পিরিচে
তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ!
তোমার হাসির মতো উড়ছে চাইনিজ পর্দা রেস্তোরাঁয়
আর একটি অস্থির নীল প্রজাপতি পর্দার বুনট থেকে উড়ে এসে
ঢুকে গেছে আমার মাথায়!
রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসছ না আজ স্বাতী?
রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবে না আর স্বাতী ?
স্রোতে রাজহাঁস আসছে
পুনর্বার স্রোতে ভাসছে হাঁস, ভাসতে দাও
কোমল জলের ঘ্রাণ মাখুক হাঁসেরা;
বহুদিন পর ওরা জলে নামছে, বহুদিন পর ওরা কাটছে সাঁতার
স্রোতে রাজহাঁস আসছে, আসতে দাও,
বহুদিন পর যেন রোদ আসছে, আসতে দাও
নত হতে দাও আকাশকে,
আর একটু নত হোক আলো
আর একটু নির্জন হোক অন্ধকার!
আর তুমি, পরে নাও তোমার গহনা, দুল
তোমার আঙুল হোক হেমন্তের ফুল,
আমি শুঁকি, শুঁকতে দাও!
বহুদিন পর যেন শুঁকছি বকুল!
বহুদিন তোমার ভিতরে যাই না, বহুদিন বকুল ফুলের ঘ্রাণ
পাই না এ মনে!
মনে করতে দাও তবু কোনখানে বকুলবাগান ছিল
গেরস্থের হাজারদুয়ারি ঘরবাড়ি
উঁচু আসন, সিংহাসন
মনে করো, মনে করে নাও
আমাদেরও সিংহাসন আছে আজও
আমাদের হাজারদুয়ারি বাড়ি আছে
মাটির ময়ূর, ঠোঁটে ঠোঁটে, ফুলে ফুলে
লুকোনো ডাকবাক্স আছে সবুজের কাছে
মনে করো আমাদেরও ভালোবাসা আছে
খাগের কলমে লেখা তাদের অক্ষরগুলি
ধানের শিষের মতো টলমলায় সেখানে শরীরে
তুমি মনে করো, মনে করে নাও
তোমার শরীরে শাড়ি,
গেরস্থের হাজারদুয়ারি ঘরবাড়ি
আলো আর অন্ধকার মনে করো, মনে করে নাও
আমরা নৌকার জলে ভাসতে ভাসতে যেন প্রতীকের হাঁস
ঐ রাজহাঁস
জল থেকে আরো জলে,
ঢেউ থেকে আরো ঢেউয়ে ছড়াতে ছড়াতে
পৌঁছে যাব আগে।
যে তুমি হরণ করো
[প্রকাশ ১৯৭৪]
কালো কৃষকের গান
দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও আমি অনাবাদি রাখব না আর আমার ভেতর!
সেখানে বুনব আমি তিন সারি শুভ্র হাসি, ধৃতপঞ্চইন্দ্রিয়ের
সাক্ষাৎ আনন্দময়ী একগুচ্ছ নারী তারা কুয়াশার মতো ফের একপলক
তাকাবে এবং বলবে, তুমি না হোমার? অন্ধ কবি ছিলে? তবে কেন হলে
চক্ষুষ্মান এমন কৃষক আজ? বলি কী সংবাদ হে মর্মাহত রাজা?
এখানে আঁধার পাওয়া যায়? এখানে কি শিশু নারী কোলাহল আছে?
রূপশালী ধানের ধারণা আছে? এখানে কি মানুষেরা সমিতিতে মালা পেয়ে খুশি?
গ্রিসের নারীরা খুব সুন্দরের সর্বনাশ ছিল। তারা কত যে উল্লুক!
উরুভুরুশরীর দেখিয়ে এক অস্থির কুমারী কত সুপুরুষ যোদ্ধাকে তো খেলো!
আমার বুকের কাছে তাদেরও দুঃখ আছে, পূর্বজন্ম পরাজয় আছে
কিন্তু কবি তোমার কিসের দুঃখ? কিসের এ হিরন্ময় কৃষকতা আছে?
মাটির ভিতরে তুমি সুগোপন একটি স্বদেশ রেখে কেন কাঁদো
বৃক্ষ রেখে কেন কাঁদো? বীজ রেখে কেন কাঁদো? কেন তুমি কাঁদো?
নাকি এক অদেখা শিকড় যার শিকড়ত্ব নেই তাকে দেখে তুমি ভীত আজ?
ভীত আজ তোমার মানুষ বৃক্ষশিশু প্রেম নারী আর নগরের নাগরিক ভূমা?
বুঝি তাই দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও তুমি অনাবাদি রাখবে না আর
এম্ফিথিয়েটার থেকে ফিরে এসে উষ্ণ চাষে হারাবে নিজেকে, বলবে
ও জল, ও বৃক্ষ, ও রক্তপাত, রাজনীতি ও নিভৃতি, হরিৎ নিভৃতি
পুনর্বার আমাকে হোমার করো, সুনীতিমূলক এক থরোথরো
দুঃখের জমিন আমি চাষ করি এদেশের অকর্ষিত অমা!
ভ্রমণযাত্রা
এইভাবে ভ্রমণে যাওয়া ঠিক হয় নি, আমি ভুল করেছিলাম!
করাতকলের কাছে কাঠচেরাইয়ের শব্দে জেগেছিল সম্ভোগের পিপাসা!
ইস্টিশানে গাড়ির বদলে ফরেস্ট সাহেবের বনবালাকে দেখে
বাড়িয়েছিলাম বুকের বনভূমি!
আমি কাঠ কাটতে গিয়ে কেটে ফেলেছিলাম আমার জন্মের আঙুল!
ঝর্নার জলের কাছে গিয়ে মনে পড়েছিল শহরে পানির কষ্ট!
স্রোতস্বিনী শব্দটি এত চঞ্চল কেন গবেষণায় মেতেছিলাম সারাদিন
ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে!
আমি উপজাতি কুমারীর করুণ নশ্বর নম্র স্তনের অপার আঘ্রাণে
প্রাচীন অনাধুনিক হয়ে গিয়েছিলাম শিশুর মতো!
আমি ভুলে গিয়েছিলাম পৃথিবীতে তিন চতুর্থাংশ লোক এখনো ক্ষুধার্ত!
আমি ভুলে গিয়েছিলাম রাজনীতি একটি কালো হরিণের নাম!
আমি ভুলে গিয়েছিলাম সব কুমারীর কৌমার্য থাকে না, যেমন
সব করাতকলের কাছে কাঠমিস্ত্রির বাড়ি, সব বনভূমিতে
বিদ্যুৎবেগবতী বাঘিনী!
যেমন সব মানুষের ভিতরে এক টুকরো নীলরঙা অসীম মানুষ!
আমি ভুলে গিয়েছিলাম বজ্রপাতের দিনে বৃক্ষদের আরো বেশি
বৃক্ষস্বভাব!
যেমন আমি ভুলে গিয়েছিলাম সব যুদ্ধই আসলে অন্তহীন
জীবনের বীজকম্প্র, যৌবনের প্রতীক!
এইভাবে ভ্রমণে যাওয়া ঠিক হয় নি আমার হৃদয়ে হয়তো কিছু
ভুলভ্রান্তি ছিল,
আমি পুষ্পের বদলে হাতে তুলে নিয়েছিলাম পাথর!
আমি ঢুকে পড়েছিলাম একটি আলোর ভিতরে, সারাদিন আর
ফিরি নি!
অন্ধকারে আমি আলোর বদলে খুঁজেছিলাম আকাশের উদাসীনতা!
মধু-র বদলে আমি মানুষের জন্য কিনতে চেয়েছিলাম মৌমাছির
সংগঠনক্ষমতা!
পথের কাছে পাখিকে দেখে মনে পড়েছিল আমার হারানো কৈশোর!
পাহাড়ে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল আমি আসলেই পথ হাঁটছি,
পথিক!
তবু ভ্রমণে আবার আমি ফিরে যাব, আমি ঠিকই পথ চিনে নেব!
অনন্তের পথিকের মতো ফের টের পাব
কে আসলে সত্যিই কুমারী, কে হরিণ কে রমণী কে-বা স্ত্রীলোক!
আর ঐ যে করাতকল, ওরা কেন সারারাত কাঠচেরাই করে!
আর ঐ যে অমৃত ঝর্না, ওকে কারা বুকে এনে এতটা স্বর্গীয় শব্দে
স্রোতস্বিনী ডাকে!
সেই মানবীর কণ্ঠ
প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে মনেও রাখবে না
আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম—কেন আমি
সংসারী না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্ন্যাসী
হয়েছি হিরণদাহ, হয়েছি বিজনব্যথা, হয়েছি আগুন!
আমি এ আঁধার স্পর্শ করে কেন তাকে বলেছি হৃদয়,
তৃষ্ণায় তাড়িত তবু কেন তাকে বলেছি ভিক্ষুক
আমি এ জলের পাত্রে জল চাই না, বিষ চাই বিষও তো পানীয়!
প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে মনেও রাখবে না
আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম, কেন আমি
এ বুক স্পর্শ করে বলেছি একদিন গ্রিস, কলহাস্য, অদিতি-উৎসব!
আমি তাম্রলিপি আমি হরপ্পার যুগল মূর্তির কার কে?
কী আমার অনুভূতি? কোনোদিন কোনোই নারীকে
কেন আমি বলি নি মাতৃত্ব? কেন বলেছি নির্জন?
প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে মনেও রাখবে না
আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম, সঙ্ঘমিত্রা নাকি সে সুদূর
সভ্যতাসন্ধির রানি, অন্য কোনো অশোকের বোন,
হয়েছি এখন আমি কেনবা এমন প্রবাহিত?
পরাজিত পদাবলি
আমার বাহু বকুল ভেবে গ্রীবায় পরেছিলে
মনে কি পড়ে প্রশ্নহীন রাতের অভিসার?
অন্ধকারে আড়াল পেয়ে ওষ্ঠে তুলে নিলে
হঠাৎ গাঢ় চুম্বনের তীব্র দহনগুলি?
মনে কি পড়ে বলেছিলে এ পোড়া দেশে যদি
বিরহ ছাড়া কিচ্ছুতে নেই ভালোবাসার বোধি—
রাজ্য জুড়ে রাজার মতো কে আর থাকে কার
রাতের পথে সহজ হবে দিনের অভিসার?
হৃদয় আজ কুপিয়ে দেই বিচ্ছেদের চারায়
দোলাই তাতে মন চেতনা মনস্তাপের ফুল!
তোমার ইন্দ্রিয়ে তার সৌরভেরা হারায়
যখন তুমি বাঁধতে বসো তোমার এলোচুল?
তোমার কাছে গিয়েছিলাম রাতে নদীর ঢেউ
তোমায় আমি পরিয়েছিলাম অঙ্গুরীয় মেয়ে
ভুল বুঝা সে মানুষ তাকে বোঝে নি আর কেউ
তুমি যেমন তোমার মতো বুঝতে চেয়েছিলে!
একজন ধর্মপ্রণেতা
(আশরাফুল আলমকে)
.
ছিলাম প্রথম ভ্রূণ খড়ের গাদায়, ছিলাম তপ্ত লোহা, তোমার জ্বলন্ত ধাতু
ছিলাম মাটির বাক্সে লুকানো মোহর, ছিলাম শিল্পের লিপ্সা
জটিল বন্ধন।
আমাকে সমুদ্রস্নানে নিয়ে যাওয়া হলো একদিন, অসতী নারীর সঙ্গে,
আমাকে অরণ্যে নিয়ে যাওয়া হলো একদিন অসতী আলোর সঙ্গে,
এক যুবতীর জলের উপরে আমাকে ভাসতে দেওয়া হলো একদিন।
আমাকে জলের অর্থ বলে দেওয়া হলো এক জেলেনির সঙ্গে শুতে দিয়ে।
আমাকে ঝর্নার নৃত্য, সীমাবদ্ধ সমুদ্র দেখতে নিয়ে যাওয়া হলো
মরূদ্যানে, হায়
আমি কত কমনীয় খর্জুরবৃক্ষ দেখলাম!
আরব্য রজনী, শাহি গণিকাদের গোলগাল নাভির অপেরা হাউস!
আমি নৃত্যপরা তাঁবুর ভিতরে কত দেখলাম ঘুঙ্গুরের ঝাঁঝট তরঙ্গ
কত দেখলাম দহনচুম্বনে বদ্ধ সিংহযূথ, নরনারী
শিশু ও লোবান আর মৃত্যু ও আতরদানি কত দেখলাম।
সার্কাসকুমারী ছিল একজন, সেইখানে তাঁবুর ভিতরে
সে আমার দিকে তার ছিন্ন ঘাগরার দ্যুতি ছুড়ে দিল,
নিদ্রার মিথুনমুদ্রা ছুড়ে দিল সেই প্রথম।
আমাকে মায়ের সঙ্গে পিতার কবর খুঁড়তে যেতে হলো, সেই প্রথম
গ্রীষ্মের ঝাপটলাগা রাত্রিতে একদিন,
শুক্লা দ্বাদশীর রাত্রে জ্যোৎস্নায় আমি মায়ের নারীত্ব ছুঁই সেই প্রথম।
আমি তার ভ্রূণের ভিতর হিংসা ভ্রাতৃহিংসা হেনে ফের
ভ্রাতৃহন্তাকারী হই, পরিব্রাজক হই
পায়ের ভিতরে আমি সেই প্রথম অনুভব দাবি করি আরো
অজস্র অজস্র পা আমার শরীরে
নৃত্য করছে নৃত্যপর—তারা
সেই প্রথম আমাকে বোঝালো,
এইসব তামসপ্রবাহে স্নিগ্ধ স্নান সেরে নাকি এক
বিলুপ্ত জাতির ফের জাগরণ হবে,
এক কান্তিমান নাকি ফিরে আসবে আবার উষ্ণীষে,
কিন্তু কই? আমি যতবার আসি
ততবার ওরা তো আমাকে আজও হত্যা করে!
হত্যা করে ফেলে!
নিঃসঙ্গতা
অতটুকু চায় নি বালিকা!
অত শোভা, অত স্বাধীনতা!
চেয়েছিল আরো কিছু কম,
আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিল
মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক!
অতটুকু চায় নি বালিকা!
অত হৈ রৈ লোক, অত ভিড়, অত সমাগম!
চেয়েছিল আরো কিছু কম!
একটি জলের খনি
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিল
একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!
তোমার চিবুক ছোঁব, কালিমা ছোঁব না
এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাব, তোমার ভিতরে এক অসম্পূর্ণ যাতনা আছেন,
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই শুদ্ধ হ’, শুদ্ধ হব
কালিমা রাখব না!
এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাব; তোমার পায়ের নিচে পাহাড় আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই স্নান কর
পাথর সরিয়ে আমি ঝর্নার প্রথম জলে স্নান করব
কালিমা রাখব না!
এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
এখন তোমার কাছে যাব
তোমার ভিতরে এক সাবলীল শুশ্রূষা আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই ক্ষত মোছ আকাশে তাকা—
আমি ক্ষত মুছে ফেলব আকাশে তাকাব
আমি আঁধার রাখব না!
এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
যে সকল মৌমাছি, নেবুফুল গাভির দুধের সাদা হেলেঞ্চা শাকের ক্ষেতে
যে রাখাল আমি আজ কোথাও দেখি না—তোমার চিবুকে
তাঁরা নিশ্চয়ই আছেন!
তোমার চিবুকে সেই গাভির দুধের শাদা, সুবর্ণ রাখাল
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই কাছে আয় তৃণভূমি
কাছে আয় পুরনো রাখাল!
আমি কাছে যাব আমি তোমার চিবুক ছোঁব, কালিমা ছোঁব না!
গোলাপের নিচে নিহত হে কবি কিশোর
গোলাপের নিচে নিহত হে কবি কিশোর আমিও ভবঘুরেদের প্রধান ছিলাম।
জ্যোৎস্নায় ফেরা জাগুয়ার চাঁদ দাঁতে ফালা ফালা করেছে আমারও প্রেমিক হৃদয়!
আমিও আমার প্রেমহীনতায় গণিকালয়ের গণিকার কাছে ক্লান্তি সঁপেছি
বাঘিনীর মুখে চুমো খেয়ে আমি বলেছি আমাকে উদ্ধার দাও।
সক্রেটিসের হেমলক আমি মাথার খুলিতে ঢেলে তবে পান করেছি মৃত্যু
হে কবি কিশোর
আমারও অনেক স্বপ্ন শহিদ হয়েছে জীবনে কাঁটার আঘাত সয়েছি আমিও।
হৃদয়ে লুকানো লোহার আয়না ঘুরিয়ে সেখানে নিজেকে দেখেছি
পাণ্ডুর খুবই নিঃস্ব একাকী!
আমার পায়ের সমান পৃথিবী কোথাও পাই নি অভিমানে আমি
অভিমানে তাই
চক্ষু উপড়ে চড়ুইয়ের মতো মানুষের পাশে ঝরিয়েছি শাদা শুভ্র পালক!
হে কবি কিশোর নিহত ভাবুক, তোমার দুঃখ আমি কি বুঝি না?
আমি কি জানি না ফুটপাতে কারা করুণ শহর কাঁধে তুলে নেয়?
তোমার তৃষ্ণা তামার পাত্রে কোন কবিতার ঝিলকি রটায় আমি কি জানি না
তোমার গলায় কোন গান আজ প্রিয় আরাধ্য কোন করতলও হাতে লুকায়
আমি কি জানি না মাঝরাতে কারা মৃতের শহর কাঁধে তুলে নেয়?
আমারও ভ্রমণ পিপাসা আমাকে নারীর নাভিতে ঘুরিয়ে মেরেছে
আমিও প্রেমিক ত্রæবাদুর গান স্মৃতি সমুদ্রে একা শাম্পান হয়েছি আবার
সুন্দর জেনে সহোদরাকেও সঘন চুমোর আলুথালু করে খুঁজেছি শিল্প।
আমি তবু এর কিছুই তোমাকে দেবো না ভাবুক তুমি সেরে ওঠো
তুমি সেরে ওঠো তোমার পথেই আমাদের পথে কখনো এসো না,
আমাদের পথ
ভীষণ ব্যর্থ আমাদের পথ।
পৃথক পালঙ্ক
[প্রকাশ ১৯৭৫]
নচিকেতা
মারী ও বন্যায় যার মৃত্যু হয় হোক। আমি মরি নাই—শোনো
লেবুর কুঞ্জের শস্যে সংগৃহীত লেবুর আত্মার জিভে জিভ রেখে
শিশু যে আস্বাদ আর নারী যে গভীর স্বাদ
সংগোপন শিহরনে পায়—আমি তাই।
নতুন ধানের ঋতু বদলের পালা শেষে
শস্যিতা রৌদ্রের পাশে কিশোরীরা যে পার্বণে আজও হয়
পবিত্র কুমারী—শোনো, আমি তাতে আছি!
আর সব যুদ্ধের মৃত্যুর মুখে হঠাৎ হাসির মতো ফুটে ওঠা পদ্মহাঁস
সে আমার গোপন আরাধ্য অভিলাষ!
বহ্নিরচনার দ্বারা বৃক্ষে হয় ফুল;
ফুলে প্রকাশিকা মধুর মৃন্ময় অবদান শোনো,
ঝর্নার যে পাহাড়ি বঙ্কিম ছন্দ কবির শ্লোকের মতো স্বচ্ছ সুধাস্রোত
স্পেনের পর্বতপ্রস্তরপথে টগবগে রৌদ্রের যে সুগন্ধি কেশরকাঁপা
কর্ডোভার পথে বেদুইন!
লোর্কার বিষণ্ন জন্ম, মৃত্যু দিয়ে ভরা চাঁদ,
শুধু সবিতার শান্তি—আমি তাই!
হারানো পারের ঘাটে জেলেডিঙি, জাল-তোলা কুঁচো মাছে
কাঁচালি সৌরভ—শোনো
সেখানে সংগুপ্ত এক নদীর নির্মল ব্রিজে
বিশুদ্ধির বিরল উত্থানের মধ্যে আমি আছি
এ বাংলায় বারবার হাঁসের নরম পায়ে খঞ্জনার লোহার ক্ষরায়
বন্যার খুরের ধারে কেটে ফেলা মৃত্তিকার মলিন কাগজ
মাঝে মাঝে গলিত শুয়োরগন্ধ, ইঁদুরের বালখিল্য ভাড়াটে উৎপাত
অসুস্থতা, অসুস্থতা আর ক্ষত সারাদেশ জুড়ে হাহাকার
ধান বুনলে ধান হয় না, বীজ থেকে পুনরায় পল্লবিত হয় না পারুল
তবু রয়েছি আজও আমি আছি,
শেষ অঙ্কে প্রবাহিত শোনো তবে আমার বিনাশ নেই
যুগে যুগে প্রেমিকের চোখের কস্তুরীদৃষ্টি,
প্রেমিকার নত মুখে মধুর যন্ত্রণা,
আমি মরি না, মরি না কেউ কোনোদিন কোনো অস্ত্রে
আমার আত্মাকে দীর্ণ করতে পারবে না।
মোরগ
ঘুরে ঘুরে নাচিতেছে পণ্ডিতের মতো প্রাণে
রৌদ্রের উঠানে ঐ নাচিতেছে যন্ত্রণার শেষ অভিজ্ঞানে!
পাখা লাল, শরীর সমস্ত ঢাকা লোহুর কার্পেটে।
মাথা কেটে পড়ে আছে, যায় যায়, তবুও নর্তক
উদয়শঙ্কর যেন নাচিতেছে ভারতী মুদ্রায়!
এই মাত্র বিদ্ধ হলো বেদনায় চিকুন চাকুর ক্র‚রতায়!
এই মাত্র যন্ত্রণায় নাচ তার সিদ্ধ হলো, শিল্পীভ‚ত হলো;
খুনের ঝোরায় তার নৃত্য ভেসে নর্তকের নিদ্রা ফিরে পায়!
শান্ত হয় স্মৃতি স্নায়ু প্রকৃতি ও পরম আকৃতি!
এখন শান্তি শান্তি—অনুভূতি আহত পাখায়
ভেঙে পড়ে আছে পাখি, গৃহস্থের গরিব মোরগ!
একদিকে পুচ্ছ হায়—অন্যদিকে আমার ছায়ায়
মুখ গুঁজে শান্ত ঐ, শান্ত সে সমাহিত, এখন নিহত!!
কল্যাণ মাধুরী
যদি সে সুগন্ধি শিশি, তবে তাকে নিয়ে যাক অন্য প্রেমিক!
আতরের উষ্ণ ঘ্রাণে একটি মানুষ তবু ফিরে পাবে পুষ্পবোধ পুনঃ
কিছুক্ষণ শুভ্র এক স্নিগ্ধ গন্ধ স্বাস্থ্য ও প্রণয় দেবে তাঁকে।
একটি প্রেমিক খুশি হলে আমি হব নাকি আনন্দিত?
যদি সে পুকুর, এক টলটলে সদ্য খোঁড়া জলের অতল।
চাল ধুয়ে ফিরে যাক, দেহ ধুয়ে শুদ্ধি পাক স্মৃতিরা সবাই।
একটি অপার জাল, জলের ভিতর যদি ফিরে পায় মুগ্ধ মনোতল।
এবং গাছের ছায়া সেইখানে পড়ে, তবে আমি কি খুশি না?
যদি সে চৈত্রের মাঠ-মিলিত ফাটলে কিছু শুকনো পাতা তবে
পাতাকুড়োনিরা এসে নিয়ে যাক অন্য এক উর্বর আগুনে।
ফের সে আসুক ফিরে সেই মাঠে শস্যবীজে, বৃষ্টির ভিতরে।
একটি শুকনো মাঠ যদি ধরে শস্য তবে আমি লাভবান।
যদি সে সন্তানবতী, তবে তার সংসারের শুভ্র অধিকারে
তোমরা সহায় হও, তোমরা কেউ বাধা দিও না হে
শিশুর মুতের ঘ্রাণে মুগ্ধ কাঁথা ভিজুক বিজনে,
একটি সংসার যদি সুখী হয়, আমিও তো সুখী
আর যদি সে কিছু নয়, শুধু মারী, শুধু মহামারী!
ভালোবাসা দিতে গিয়ে দেয় শুধু ভুরুর অনল।
তোমরা কেউই আঘাত করো না তাকে, আহত করো না।
যদি সে কেবলি বিষ—ক্ষতি নেই—আমি তাকে বানাব অমৃত!
নর্তকী ও মুদ্রাসঙ্কট
তুমি যখন নৃত্য করো মুদ্রাগুলি কাঁপে
তোমার হাতের মধ্যে তো নয় যেনবা কিংখাবে,
তলোয়ারের মতন তুমি তোমার দু’হাত তোলো,
চোখের নিচের নগ্নতাকে ছন্দ পেয়ে ভোলো।
আমি তখন আমার পোড়া দেশের পাপে মরি।
নিজের কাছে নিজের দেহ তীব্র তুলে ধরি।
তুমি তো নও আম্রপালী, বর্তমানের নারী
তোমার লাগে লিনোলিয়াম সিফনঘেরা শাড়ি
তোমার লাগে সাত প্রেমিকের সুলভ করতালি,
বাগান তুমি, যুবারা যেন তোমার কেনা মালি।
হাজার ফুলের মধ্যে দুটি ফুলের অনুতাপে
মর্মাহত মালিরা তবু তোমার বুকে কাঁপে।
কিন্তু বুকের কাছে কি আর সেই ফুলেরা আছে
দেবদাসীরা যখন পূজায় পুরোহিতের কাছে
রাখত জমা যাতনা আর জরার অভিমান
পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে বলত, হে সম্মান
আমাকে দাও শস্যকণা আমাকে দাও তীর
প্রাণের পাশে পরমায়ুর ঝর্না সুনিবিড়।
এখন শুধু হাতের কাঁপন, দিনযাপনের গ্লানি
মুদ্রা তুলে জাগাও তুমি অতনু একখানি
অনাশ্রয়ের অনিদ্রা আর অভিমানের গান :
যেখানে ভালোবাসারও নেই সুযোগ্য সম্মান।
ধরিত্রী
পাতাকুড়োনির মেয়ে তুমি কী কুড়োচ্ছ? ছায়া, আমি ছায়া কুড়োই!
পাখির ডানার সিক্ত সবুজ গাছের ছায়া, গভীর ছায়া, একলা মেঘে
কুড়োই, হাঁটি মেঘের পাশে মেঘের ছায়া—ছায়া কুড়োই।
পাতাকুড়োনির মেয়ে তুমি কী কুড়োচ্ছ? পাতা, আমি পাতা কুড়োই!
কয়টি মেয়ে ঝরাপাতা : ঝরছে কবে শহরতলায়,
শিরায় তাঁদের সূক্ষ্ম বালু,
পদদলিত হৃদয় ক’টি, বৃক্ষবিহীন ঝরাপাতা—
কুড়োই আমি তাদের কুড়োই!
পাতাকুড়োনির মেয়ে তুমি কী কুড়োচ্ছ? মানুষ, আমি মানুষ কুড়োই।
আহত আর নিহত সব মানুষ কারা বাক্স খুলে ঝরায় তাদের রাস্তাঘাটে।
পঙ্গু—তবু পুণ্যে ভরা পুষ্প : তাদের কুড়োই আমি, দুঃখ কুড়োই!
আর কিছু না? বটেই—আরো আছে অনেক রঙ-বেরঙের ঝরাপাতা,
আমার ঝাঁপি উল্টে পড়ে মন্বন্তরের মৃত্যুবীজে
লক্ষ্যবিহীন লাল খনিজে!
সবাই আমার স্বার্থে ভিজে সবটুকু হয় স্বার্থবিষয়
সবটুকু হয় শুদ্ধ ব্যথা
তাদের অন্য কুলোয়, তাদের ঝাড়ব আমি অন্য হাওয়ায়
যেমন করে শস্যভিটায় শস্য ঝাড়ার সময় এলে, শস্যে কুড়োই সচ্ছলতা,
এবার আমার ঝরাপাতার শস্য হবার দিন এসেছে
শস্য কুড়োই, শস্যমাতা!
যুগলসন্ধি
ছেলেটি খোঁড়ে নি মাটিতে মধুর জল!
মেয়েটি কখনো পরে নাই নাকছাবি।
ছেলেটি তবুও গায় জীবনের গান,
মেয়েটিকে দেখি একাকী আত্মহারা!
ছেলেটির চোখে দুর্ভিক্ষের দাহ,
মেয়েটির মুখে কত মায়া মৌনতা;
কত যুগ যায়, কত শতাব্দী যায়!
কত যুগ ধরে কত না সে বলিদান!
ছেলেটি খোঁড়ে নি মাটিতে মধুর জল,
মেয়েটি দেখে নি কখনো বকুল ফুল।
ছেলেটি তবুও প্রকৃতি-প্রতিনিধি;
মেয়েটি আবেগে উষ্ণ বকুলতলা!
ছেলেটি যখন যেতে চায় দক্ষিণে,
মেয়েটি তখনো ঝর্নার গান গায়;
মেয়েটির মুখে সূর্যাস্তের মায়া!
ছেলেটি দিনের ধাবমান রোদ্দুরে!
কত কাল ধরে কত না গোধূলিতলে,
ছেলেটি মেয়েটি এর ওর দিকে চায়!
কত বিচ্ছেদ কত না সে বলিদান!
কত যে আকাল শুভকাল পানে ধায়!
ছেলেটির গায়ে বেঁধে কত বল্লম;
মেয়েটির মনে কত মেয়ে মরে যায়!
ছেলেটি যদিও আঘাতে আহত তবু,
মেয়েটি আবার মেয়ে হয়ে হেসে ওঠে।
কত বিদ্রোহ, কত না সে বলিদান;
পার হয় ওরা কত না মহামারী!
ছেলেটির বুকে মেয়েটির বরাভয়;
মেয়েটির চোখে ছেলেটির ভালোবাসা!
একজন ফের উদ্যানে আনে ফুল,
একজন মাঠে ফলায় পরিশ্রম;
কত না রাত্রি কত না দিনের ডেরা,
কত না অশ্রু, কত না আলিঙ্গন!
ছেলেটি আবার খোঁড়ে মাটি খোঁড়ে জল!
মেয়েটি আবার নাকে পরে নাকছাবি,
ছেলেটির চোখে মেয়েটির বরাভয়;
মেয়েটিকে দেখি একাকী আত্মহারা!!
জরায়ু আমি জরায়ু ছিলাম
জরায়ু আমি জরায়ু ছিলাম, হয়ে গেলাম মানুষ, না হয়
সেইখানে তো ফুটতে ছিলাম
মায়ের ভ্রূণে গর্ভাশয়ে ফুলের মতো
অমল ধবল ফুটতে ছিলাম;
ছলছলানো জলের যোনি
ঘূর্ণি মেরে ফুটতে থাকা একলা খুনি
করাতধারে চিড়তে ছিলাম মাংস মায়ের
মাখতে ছিলাম ভেতরব্যাপী বৃত্তজুড়ে
মায়ের মধুর অন্তঃপুরে
কোন বিদেশি ডাকাত তাকে ছিঁড়তে গেল? ছিঁড়তে গেল?
টাকার মতো রুপোয় ঢাকা রাত্রি তাকে ছিঁড়তে গেল?
বাবা? নাকি অসম্ভবা জন্ম আমার?
কোন বিদেশি ধর্মাধর্ম ছিঁড়তে গেল? ছিঁড়তে গেল?
একলা একা শুয়ে থাকার, গন্ধ মাখার শান্তি অগাধ?
এখন আমার ক্লান্তি বড়, শরীর ভরা জড়োসড়ো,
ঘুণপোকা আর থোকাথোকা ঘামমলমূত্র বহন করি,
জখম করি নিজের জন্ম জখম করি, জখম করি,
ত্রিশূলবিদ্ধ শুয়ার যেমন, জখম করি নিজের দুয়ার
পেছন পাগল সকল আহার,
আত্মা থেকে অমল বাহার;
ফুলের মতো একলা থাকার গর্ব নিয়ে ফুটতে ছিলাম মায়ের ভ্রূণে,
কী কুক্ষণে ডাকাত বেনে, ছিঁড়তে গেল ছিঁড়তে গেল?
ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও!
শেষ মনোহর
সে আমার পাশে শুয়েছিল, বাঁশির মতন বিবসনা!
তাকে আমি দেখেছিলুম কাঁদতে গুণীর হাতের বেহালার মতো
আর মাত্র কিছুক্ষণ : এর মধ্যে নক্ষত্র ফুরোবে :
এর মধ্যে শেষ হবে আমাদের আলিঙ্গন আমাদের অনিদ্র চুম্বন!
পাতলা ঝাউয়ের মতো কেঁপে উঠল কণ্ঠ তার
কেন তুমি এইভাবে, এরকম দিলে?
সন্তের শূন্যতা নিয়ে পাশ ফিরে শুই—একা শুই!
সে আমাকে হঠাৎ উন্নত স্বরে বলে ওঠে ‘অহিংস ঘাতক!’
বটেই তো, না হলে কি আমি আজ তার মতো কাঁদি?
অগ্রন্থিত কবিতা
[প্রকাশ ১৯৮৫]
আদিজ্ঞান
এতটা বয়স চলে গেল, তবু কী আশ্চর্য, আজও কি জানলাম,
বনভূমি কেন এত ভিন্ন ভিন্ন বৃক্ষ নিয়ে তবে বনভূমি?
জল কেন এত স্বচ্ছ স্রোত নিয়ে তবে স্রোতস্বিনী?
রক্ত কেন এত রক্তপাত নিয়ে তবে স্বাধীনতা?
এতটা বয়স চলে গেল, তবু কী আশ্চর্য, আজও কি জানলাম,
বনভূমি লোকালয় থেকে কেন এত দূরে থাকে?
কিশোরীরা কেন এত উদাসীন, কেন এত নির্জনতাপ্রিয়?
আর নদী কেন গভীরতা ছাড়া ঠিক ধারামতো চলতে পারে না?
এতটা বয়স চলে গেল, তবু কী আশ্চর্য, আজও কি জানলাম,
চড়ুইয়ের ঠোঁটে কেন এত তৃষ্ণা? খড়ের আত্মায় কেন এত অগ্নি, এতটা দহন?
গোলাপ নিজেই কেন এত কীট, এত মলিনতা নিয়ে তবুও গোলাপ?
এতটা বয়স চলে গেল, তবু কী আশ্চর্য, আজও কি জানলাম,
একটি শিশুর কেন এত নিদ্রা, এত গাঢ় ঘুম আর
তখন আমরা কেন তার মতো ঘুমুতে পারি না?
দাসেরে করিও ক্ষমা
গণিকা আমার অপ্সরা প্রিয়তমা
শাড়ি খুলে রেখে পরো আকাশের নীল,
যুগল কুসুমে থরো থরো অনুপমা
চোখ দুটো হোক স্বপ্নের গাঙচিল।
গণিকা আমার অপ্সরা সোনামণি
আঙুলে বাজাও রুপার মুদ্রা টাকা,
শঙ্খিনী ফণা তোলো তুমি এক্ষুনি
বিষে ভরে যাক বাদশাহী আঙরাখা।
নেহাত ভৃত্য, বাদশাহি করি কেন?
তুমি প্রিয় তুমি জানো নাকি শাহজাদি?
পকেটে তোমার মোহরের ধ্বনি যেন
সসাগরা দেশ, পৃথিবী করেছে বাঁদি।
আমারই কেবল, আমারই হে প্রিয়তমা
তুমি তো আমার স্বদেশের শাহজাদি
যুগল কুসুমে থরো থরো অনুপমা,
তুমি তো আমার সোনামণি, শাহজাদি।
গণিকা আমার অশ্লীল অভিমান,
তবুও যখন দুর্ভিক্ষের অমা
গ্রাস করে দেশ, নাভিতে সবুজ ধান
বুনে দিয়ে তুমি ‘দাসেরে করিও ক্ষমা’।
আমার আত্মার সেই সুন্দরের আর্শিটি
ভেবেছ আর্শি একা? পারদের কেবল বন্ধনী?
ভিতরে সে কিছু নয়? কেবল প্রতিবিম্ব ধারণের ছায়া মাত্র?
কিন্তু আমি জানি আর্শিও অনেক কথা জানে!
দ্রৌপদীর শাড়ির মতন তারও ভিতরে রহস্য খুলে খুলে
বলতে পারে তোমাদের কে কতটা সত্যিকার নারী!
আর্শি ধরে রাখে সব, সুখ দুঃখ অন্তর্গত শিল্পে সহবাস,
এলোচুল, কালোচুল, খোলাচুল সব আর্শি বুকে তুলে রাখে
দুঃখিনীর কোলজোড়া দারিদ্র্য দয়ার চিহ্ন কম্পনের কথা সেও জানে!
আমি জানি তোমার স্তনেরও পরিমাণ আর্শির নিকটে জমা আছে!
তোমার অশ্রুর তুমি কতটুকু, তোমার দুঃখের তুমি কতটুকু, তাও তার জানা!
আর গতকাল তুমি সজল শাসনে কেন কোমল ও-দুটি চোখ
বেঁধে নিজ শরীরের একাকিত্ব দেখতে চেয়েছিলে, কেন তুমি
রোদ্দুরে রোয়াকে বসে কাত হয়ে সূর্যাস্তের পতন দেখেছিলে
তাও আর্শি জেনে গেছে আমার আত্মার তলে সেই সুন্দরের আর্শিটি!
দু’মুঠো চাল
দু’মুঠো চাল, দু’বেলা যেন দোয়েল ডাকে বনঝাউয়ের ডালে
দু’খানা শাড়ি, ঘাসবরন, যদি না এক গরিব মেয়ে বলে :
সব মানবই মাটির গা; আমরা তার আবহমান পুতুল
দু’বেলা দু’টি সাদা ভাতের উপমা দিয়ে সাজাই জুঁই ফুল।
গলায় কোনো লাজবরন গয়না না থাক, মাঝরাতের আঁখি
ইশারা দিয়ে হুইসিলের মতো—শত যাত্রীকে তো ডাকি!
এখনো আছে হাতের লাল সুতোয় বাঁধা অন্ধকারের তাবিজ
ঝলক দিলে এখনো রাতে ডাকতে পারি অনেকই বেতমিজ;
এবং তারা হাতদে’ খোলে আমার শোভা আমার আন্ধার!
যুবতী মোরা, সেই সুবাদে কত না পুরু প্রাচীন পাতাবাহার
ডালপালায় নগ্ন এক অবিশ্বাসী সর্পফণা তুলি
কালো যুবার সামনে তখন কেউটে হয়ে রাত্রিবেলা দুলি।
কিন্তু সে যে লখিন্দর। হঠাৎ সাপ বেহুলা হয়ে কাঁদে।
দু’মুঠো চাল, দু’মুঠো ফণা, বিষ বদলে বিষাক্তকে বাঁধে।
দু’মুঠো চাল জুঁই ফুলেরই মতন সাদা প্রাণের প্রণিপাত—
হঠাৎ তাও হত্যা করি অক্রুরের বাণের অপবাদ।
হঠাৎ দাও অন্ধকার, মা আমার হোক আবার নদী
এবং শুশুক হয়ে ভাসি, ভুসুখ হয়ে সাজাই তার বোধি।
হরিণ
‘তুমি পর্বতের পাশে বসে আছ :
তোমাকে পর্বত থেকে আরো যেন উঁচু মনে হয়,
তুমি মেঘে উড়ে যাও, তোমাকে উড়িয়ে
দ্রুত বাতাস বইতে থাকে লোকালয়ে,
তুমি স্তনের কাছে কোমল হরিণ পোষো,
সে-হরিণ একটি হৃদয়।’
যুগলসন্ধি
দেখা হলো যদি আমাদের দুর্দিনে
আমি চুম্বনে চাইব না অমরতা!
আমাদের প্রেম হোক বিষে জর্জর
সর্পচূড়ায় আমরা তো বাঁধি বাসা।
থাকুক দু’চোখে দুর্ভিক্ষের দাহ,
ঝরুক আবার আন্ধার আধিব্যাধি
আমাদের প্রেম না পেল কবির ভাষা
কাব্যচূড়ায় আমরা তো বাঁধি বাসা।
আমি খুঁড়ব না দু’চোখে দীর্ঘ জল,
ভাঙা যৌবন চিৎকার যদি করে,
কাজ নেই আর উল্টো নদীর বেগে,
অনাবেগে হোক আমাদের যাওয়া আসা!
কাজ নেই আর আবেগের কড়চায়
ভুলে যাও কবে ফুটত বকুল ফুল।
না হয় আমিই হব তার প্রতিনিধি
ক্ষতি কী, তুমি তো আছই বকুলতলা!
আমি যদি চাই যেতে ফের দক্ষিণে
তুমি বলে দিও ঘরে বাড়ন্ত চাল!
শুনব না আর নকল নদীর গান,
তার চেয়ে তুমি কাঁকনে কাঁদন তুলো!
বিঁধুক এ বুক তোমাতে কান্নাময়!
আমি নিষেধের অঙ্গুলি তুলব না,
অকালের প্রেমে শুভকাল হলে হোক
আমাদের ক্ষণজীবনের ক্ষণক্রন্দন!
দেখা হলো যদি আমাদের দুর্দিনে
আমি চুম্বনে চাইব না অমরতা!
আমাদের প্রেম হোক বিষে জর্জর
সর্পচূড়ায় আমরা তো বাঁধি বাসা!
ফুটুক তোমার অঙ্গে অগ্নিফুল
ক্ষতি কী, শরীরগ্রন্থিতে গেঁথে নেব
আমাদের প্রেম না পেল কবির ভাষা
কাব্যচূড়ায় আমরা তো বাঁধি বাসা।
PREVIOUSব্রাজিলের চার কবি'র কবিতা
NEXTপ্রিয় ১৫ : মোশতাক আহমদের কবিতা
আরও পড়ুন
তীব্র ৩০ : সৈয়দ তারিকের বাছাই কবিতা
আমাকে বাঁচায়ে রাখে কেবল একটা ইগো
বিজ্ঞাপন
এই লেখকের অন্যান্য লেখা
‘নিমজ্জন’ আড্ডাকবি ও সম্রাট : আহমদ ছফাপরস্পর ঈদ আয়োজন ২০১৮ঈদসংখ্যার কবিতারুধিররঙ্গিণী : ৫ দিনের টানা প্রদর্শনী
এ মাসের সর্বাধিক পঠিত
তীব্র ৩০ : আবুল হাসানের বাছাই কবিতা
0
কানাডীয় সাহিত্যে বিশ্বসাহিত্যের স্বাদ
0
আসন্ন ম্যান বুকার পুরস্কার ও কানাডা প্রসঙ্গ
0
0
তীব্র ৩০ : সৈয়দ তারিকের বাছাই কবিতা
0
ইমেইলে আপডেট নিন
Name
Email *
সমন্বয়ক : মহসীন চৌধুরী জয়
অলংকরণ : সারাজাত সৌম
যোগাযোগ : porospor2015@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন