গল্প
বাহিরে প্রচন্ড রোদ। মেক-আপ গলা রোদ পড়েছে। এই তীব্র গরমেও আমার কেমন শীত শীত লাগছে। মনে হচ্ছে কোন ঘোরে চলে যাচ্ছি। পাশ ফিরে মহীনকে ডেকে বললাম কম্বলটা উপরে চাপিয়ে দাও। মহীন পড়ছিল, ওর চোখেমুখে খানিকটা বিরক্তি। আমি সেই বিরক্তি সম্পুর্ন উপেক্ষা করে আবার বললাম। এবার মহীন উঠেছে। কথামত কম্বলটা গায়ে চাপিয়ে দিয়ে আবার পড়তে বসলো। আমার কেমন ঘুম ঘুম লাগছে। আমি তীব্রভাবে চাইছি যাতে ঘুমিয়ে না পড়ি। ঘুমিয়ে পড়লেই এই অনুভুতিটা পাবোনা।কিছু খুচরো টাকার অভাবে? একটা সিগারেট কিনতে পারছিনা। আমার কাছে এখন চকচকে তিনটা একহাজার টাকার নোট আছে। অভ্রদের বাসা থেকে এবার টাকা দেয়ার সময় ওরা কেমন নিষ্পাপ মুখ করে বলেছে আমাকে নাকি আর পড়াতে হবেনা। হঠাৎ করেই ঘুম কেটে গেলো, শীত শীত ভাবটাও চলে গিয়েছে। হঠাৎ কেমন শুন্যতা কাজ করছে। স্যান্ডেল জোড়া পায়ে দিয়ে বাসা থেকে বের হলাম। রাস্তায় রাস্তায় যত কোচিং সেন্টার পাবো, সেখানের পরিচালককে ফোন দিয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলবো পড়াতে চাই। আমারর একটা টিউশানী দরকার। আজকাল কিংবা পরশু। একটা টিউশানীর জন্যে অনেক কিছু আটকে আছে। ভেবেছিলাম একদিন হাজীর বিরিয়ানী যেয়ে পেটপুরে কাচ্চি খাবো,টাকার অভাবে যেতে পারছিনা। মাস শেষে অভ্রদের থেকে যে টাকাটা পেতাম তা দিয়ে মেসে থাকা খাওয়াটা চলে যেতো। এখন এটাও নেই।
ধানমন্ডি লেকে বসে আছি ঘন্টাতিনেক হলো। কিছু তরুনকে দেখা যাচ্ছে চোখে মুখে স্বপ্ন নিয়ে পথশিশুদের পড়াচ্ছে, তারা দেশ পাল্টে দেবার স্বপ্নে বিভোর। এখানে আরো কিছু তরুন আছে, তাদের চোখেও স্বপ্ন! তবে, তা প্রেমিকা'কে আকুল করে পাবার জন্যে।
হঠাৎ করেই চোখে পড়লে একটা মেয়ে কেমন অসহায় ভঙ্গিতে বসে আছে। তার মুখে কেমন তীব্রতা। তাকে দেখে আমার নির্বাসিত মহিলা কবি'র একটি কবিতার লাইন মনে পড়ে গেলো। 'এই যে চারিদিকে এত পুরুষ, কই প্রেমিক তো দেখি না '।ভাবছি মেয়েটার পাশে যেয়ে বসি।মেয়েটার কাছে এলাম। আপনার কাছে কি একহাজার টাকার ভাংতি হবে? মেয়েটা তার জোড়া ভ্রু কুচকে আমার দিবে তাকালো।ভ্রু কুচকানো অবস্থায় মেয়েটাকে কেমন সুন্দরী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ভ্রু কুচকানো প্রতিযোগিতায় এই মেয়ে ফার্স্ট হবে। এবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার কাছে ভাংতি চাইছেন কেনো? আপনার কি মনে হয় আমি এখানে বসে সবাইকে ভাংতি দিয়ে বেড়াই? আমার আশেপাশে কোথাও কি লিখা আছে, 'এখানে পাঁচশ একহাজার টাকার ভাংতি দেয়া হয় '। নিজেকে জীবনের এই প্রথমবার অপ্রস্তুত মনে হচ্ছে আমার।এই মেয়ে দেখি বাসা থেকে ঝগড়ার সাজ সরন্জাম নিয়ে বের হয়েছি।আমার মত উস্কখুস্কু ছেলে একজন রুপবতী মেয়ের সাথে ঝগড়া করতে পারেনা, করলেও প্রকৃতি মানবেনা। তাই ওখান থেকে সটকে পরলাম। আবার হাটতে শুরু করলাম। গন্তব্যহীন। এই ঢাকা শগরে আমার পরিচিত যতজন থাকে তারা প্রত্যেকেই আমাকে দেখলে ভয়ে থাকে। না জানি কখন কারো কাছ থেকে টাকা ধার চেয়ে বসি। অথচ সত্যি হচ্ছে আমি কখনোই কারো কাছ থেকে টাকা ধার করিনি।হাটতে হাটতে মগবাজার চলে এসেছি। হঠাৎ মনে হলো এখানে আমার বড় আপার বাসা।আপার বাসায় যেয়ে কলিংবেল চাপলাম। দরজা খুলে আপা বললো, কি রে তুই! কতদিন পর এলি। তোর ভাগনী তো মামার নাম শুনলে অস্থীর।তারপর আপার রুমে বসলাম।আপা বললো, খালি হাতে এসেছিস? আমি হাসলাম।আপা বললো, আমি এখানে শশুরশাশুরীদের সাথে থাকি। প্রিয়তীর একটা মাত্র মামা সে যদি খালি হাতে আসে আমি কিভাবে তাদের সাথে মুখ ধরি! আমি বললাম, আপা ক্ষুদা লেগেছে। ভাত দাও। আপা দিচ্ছি বলে রান্নাঘরে গেলো। আমি প্রিয়তী'র দিকে তাকিয়ে মুচকী হাসলাম। প্রিয়তী বললো, মামা গতকাল বিকেলে পতপত বলেছিল আজকে তুমি আসবে। পতপত কে প্রিয়তী? আমি জিঙেস করলাম।পতপত হচ্ছে একটা কাঁক।আমার বন্ধু,প্রায়ই আসে আমার সাথে গল্প করতে। আমি বললাম,প্রিয়তী পতপত যা বলে তাই কি হয়? প্রিয়তী বললো, হ্যা হয়। আমি বললাম তাহলে পতপত আবার আসলে জিঙেস করো তো তোমার বিয়ে কবে হবে? প্রিয়তী কপট রাগের ভান করে মুখে লজ্জা লজ্জা ভাব এনে চলে গেলো। এই সুযুহে আমি আপার বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। বের হয়েই একটা বাস পেয়ে উঠে গেলাম।আজকে বাস আমায় যেদিকে নিয়ে যাবে আমি সেদিকেই যাবো। ভু-পর্যটক রমানাথ আর বাস পর্যটক তপু।আমার আবার ঘুম পাচ্ছে। পর্যটকের মত বাহিরে না তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ বাসের হেল্পারের ডাকে ঘুম ভাঙলো। হেল্পার বললো, ভাইজান বাস তো আর যাইবো না, ভাড়া দেন। আমি ভাড়া দিয়ে বাস থেকে নামলাম।
হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি সোমলতা। বুকে কেমন ধাক্কার মত লাগলো। সোমলতার দুই বছরের বেশী সময় ধরে পালিত বিদেশী কুকুরটাও আজকাল যেখানে আমাকে দেখলে ঘেউ করে উঠে। ঠিক সেই অবস্থায় আমাকে দেখতে পেয়ে সোমলতা যেই অগ্নিদৃষ্টি দিলো তাতে খুশী না হয়ে পারা যায় না।খুশী প্রকাশ করতে যেয়ে চোখ মুখে সেটার খানিক প্রকাশ ঘটালাম। তখন সোমলতা তার অগ্নিদৃষ্টির ভোল্টেজ আরো খানিক বাড়িয়ে সেই তিনশ বাইশ রাত আগের মতন করো আদুরে গলায় জিঙেস করলো, "তুমি এত নির্লজ্জ কেনো"?আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। কোন এক মহাপুরুষ একবার বলেছিলেন, রুপবতীদের সব কথায় উত্তর দিতে নেই।আমার সামনে এখন যে দাড়িয়ে আছে তাকে যদি কেউ রুপবতী না বলে তার উচিত হবে হবিগন্জের কালীসাধক সুবোধের তেল পড়া চোখে দেয়া। তাই আমি তার কথার উত্তর না দিয়ে আমার গোটা চারেক দাঁত দেখিয়ে বিকট এক হাসি দিলাম। আমার মনে হলে আমার এহেন আচরনে সোমলতা যেকোন সময় অত্যন্ত হিংস্রভাবে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়তে পারে। আমি এই মহূর্তে চাচ্ছি না ও আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ুক।কোন রুপবতী মেয়ে মাঝ রাস্তায় মাঝ দুপুরে মাঝ বয়সী কোন যুবকের উপর ঝাপিয়ে পড়বে এটা আশেপাশের সবার জন্য খুবই বিব্রতকর।ভয়ে কিংবা প্রচন্ড রোদে আমি সোমলতা'কে বললাম চলো।
এখন আমরা যাচ্ছি শ্যামলী রিংরোড ধরে আদাবরের দিকে। গন্তব্যহীন,সোমলতা সেই আগের মত রিক্সা ঘন্টায় ভাড়া করেছে। আজকে সারা ঢাকা শহর ঘুরবো এমন মনোভাব আমাদের। হঠাৎ সোমলতা বলে উঠলো, তোমার গা থেকে বিশ্রী ঘামের গন্ধ আসছে।রিক্সা থেকে নেমে একটা ডেটল সাবান কিনে আনো। তারপর কোন দিন আমার সামনে পড়ার আগে অবশ্যই ডেটল সাবান দিয়ে একশভাগ জীবানুমুক্ত হয়ে আসবে। ঝিকাতলার দিকে আসার পর আমাদের রিক্সা ছোট্ট একটা জ্যামে আটকা পড়লো, সোমলতা তার ব্যাগ থেকে একটা চকচকে পাচঁশ টাকার নোট দিয়ে বললো, যাও সাবান কিনে আনো। আমি কিছু না বলে সুদৃশ্য পাঁচশ টাকার নোট টা নিয়ে রিক্সা থেকে নেমে গেলাম। এবং নেমে একটা কানাগলির ভিতরে ঢুকে পড়লাম। সোমলতা রিক্সায় আমার জন্যে অপেক্ষা করছে, করুক। আমি গলির ভিতরে হাটতে থাকলাম। হাটতে হাটতে একটা ঋণাত্মক স্টার পাবে এমন একটা হোটেলের সামনে দাড়িয়ে পড়লাম।নাম কাশ্মীরি তেহারী ঘর।মনে পড়লো সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। ওখান থেকে সুন্দর তেহারীর ঘ্রান আসছে। আব্দুল্লাহ ভাই একবার বলেছিলেন, তেহারীর ঘ্রানটাই নাকি আসল, একবার এই ঘ্রান নাকে টেনে নিতে পারলে তিনদিন না খেয়ে থাকা যায়। ওনার কথামতো আমি তেহারীর বিশাল ডেকচির সামনে দাড়িয়ে ঘ্রান টেনে নিলাম। সাথে সাথে আমার পেটের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল ক্ষিদায়।ভাবনা কি, সোমলতার চকচকে সুদৃশ্য নোট টার একটা সুগতি হবে ভেবে আনন্দিত হলাম।
এখন ঢাকা শহরের কাছে রাত তেমন বেশী নয়, মানুষজন এখনো ঘুমের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেনি। কলেজ পড়ুয়া ছেলেরা কিছুক্ষন হয় পড়তে বসেছে। বাহিরে টুপটাপ টুপটাপ বৃষ্টি কিছুক্ষন আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। মুহুর্তেই গ্রামের কথা মনে হয়ে গেলো, ওখানে এখন মোটামোটি ঘুমের সময় হয়ে এসেছে। ঠিক এমন ই একটা রাত ছিল সেদিন। কি থেকে কি হয়ে গেলো। থাক সেসব আপাতত বাদ থাকুক।
পাশের বাসা থেকে হালকা সাউন্ডে গান ভেসে আসছে, প্যাসেন্জারের লেট হার গো।আমি গান শোনায় মনোযোগ দিলাম। গান শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বলতে পারবো না। আমাকে কে যেনো ডাকছে, এই তপু এই তপু বলে। আমার ঘুম ভেঙে গেলেও চোখ খুলতে চাইছেনা।আমি দশ সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে চিন্তা করতে চাইলাম কে হতে পারে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন